পূর্বের অধ্যায়গুলোতে আমরা সমাজ, সরকার ও রাষ্ট্র, নাগরিকের অধিকার ও কর্তব্য এবং নাগরিক জীবনের বিভিন্ন সমস্যা ও তার সমাধান সম্পর্কে জেনেছি । এ অধ্যায়ে আমরা ইতিহাস থেকে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে দেশের নাগরিকদের ভূমিকা সম্পর্কে জানব ।
এ অধ্যায় পাঠের মাধ্যমে আমরা-
♦ ভাষা আন্দোলন, বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও আদর্শ এবং অসাম্প্রদায়িক মূল্যবোধ জানতে ও ব্যাখ্যা করতে পারব
♦ দেশপ্রেমের গুরুত্ব ব্যাখ্যা ও উপলব্ধি করতে পারব ।
১৯৪৭ সালে দ্বিজাতি তত্ত্বের উপর ভিত্তি করে ভারত উপমহাদেশ ভাগ হয়ে পাকিস্তান (১৪ আগস্ট, ১৯৪৭) এবং ভারত (১৫ আগস্ট, ১৯৪৭) নামে দুটি স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম হয়। তৎকালীন পূর্ব বাংলা পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় পরবর্তীকালে এর নাম হয় পূর্ব পাকিস্তান। ১৯৭১ সালে স্বাধীন হওয়ার আগে আমরা ছিলাম পাকিস্তানের নাগরিক। জনসংখ্যার দিক থেকে সংখ্যাগরিষ্ঠ (৫৬ শতাংশ) হওয়া সত্ত্বেও সে সময়ে পূর্ববাংলার (বর্তমান বাংলাদেশ) মানুষ নাগরিক হিসেবে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক অধিকার ভোগের ক্ষেত্রে সমান সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ১৯৪৮-১৯৭১ পর্যন্ত বিভিন্ন আন্দোলন সংগ্রামের মাধ্যমে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার কারণে এখন বাঙালিরা স্বাধীনভাবে তাদের নাগরিক অধিকার ভোগ করতে পারছে।
পাকিস্তানি শাসনের (১৯৪৭-১৯৭১) আগে বাংলাদেশের এই অঞ্চল তুর্কি, আফগান, মুঘল এবং পরিশেষে ব্রিটিশ শাসনের (১৭৫৭-১৯৪৭) অধীন ছিল । ঔপনিবেশিক শাসন আমলে আমাদের এ অঞ্চলে দুটি বড় পরিবর্তন ঘটে। প্রথমতঃ ইংরেজি শিক্ষার বিস্তার ঘটে। এর ফলে আমরা পাশ্চাত্যের সাহিত্য-সংস্কৃতি ও রাজনৈতিক ধ্যান-ধারণার সাথে পরিচিত হই। ইংরেজি শিক্ষার প্রসারের ফলে সমাজ সংস্কার আন্দোলন ও জাতীয়তাবাদী চেতনা জাগরিত হয়েছে। দ্বিতীয়তঃ ঔপনিবেশিক সরকার আমাদের দেশে অনানুষ্ঠানিক স্থানীয় সরকার ব্যবস্থার (পঞ্চায়েত) পরিবর্তে নতুন ধরনের স্থানীয় সরকার ব্যবস্থার (ইউনিয়ন কাউন্সিল বোর্ড) প্রবর্তন ঘটিয়েছে এবং কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক পার্লামেন্টারির ব্যবস্থার প্রবর্তন ঘটিয়েছে। ১৮৬১ সাল থেকে শুরু হওয়া বিভিন্ন শাসনতান্ত্রিক সংস্কার ও এর পথ ধরে পর্যায়ক্রমে জনগণ ভোটের অধিকার লাভ করে । এসবই ছিল ঐ সময়ে নাগরিক অধিকার ও সচেতনতা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি ।
ব্রিটিশ শাসন আমলে অবিভক্ত ভারতে সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুদের পাশাপাশি মুসলিম জনগোষ্ঠীর মধ্যেও স্বশাসনের চেতনা জাগ্রত হয় । মুসলিম স্বার্থের প্রতিনিধিত্ব করার জন্য ১৯০৬ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় মুসলিম লীগ । ১৯৩০ সালে কবি আল্লামা ইকবাল মুসলমানদের জন্য আলাদা রাষ্ট্রের প্রয়োজনীয়তার কথা উল্লেখ করেছেন। ১৯৩৩ সালে ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র চৌধুরী রহমত আলী ভারতের পশ্চিমাঞ্চলের মুসলিম এলাকাগুলো নিয়ে পাকিস্তান নামক একটি রাষ্ট্রের রূপরেখা অঙ্কণ করেন ৷ ১৯৩৯ সালে মুসলিম লীগ নেতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে ভারতের মুসলমানদেরকে একটি স্বতন্ত্র জাতি হিসেবে ঘোষণা করেন । যার ফলে পরবর্তীকালে মুসলমান জনসাধারণের মধ্যে আলাদা আবাসভূমির চিন্তা জাগ্রত হয় ।
এই চিন্তাধারার আলোকেই ১৯৪০ সালের ২৩শে মার্চ পাঞ্জাবের লাহোরে অনুষ্ঠিত মুসলিম লীগের বার্ষিক কাউন্সিল অধিবেশনে বাংলার মুখ্যমন্ত্রী এ. কে. ফজলুল হক উপমহাদেশের মুসলমানদের স্বার্থ-সম্বলিত একটি প্রস্তাব পেশ করেন। জিন্নাহর সভাপতিত্বে সভায় প্রস্তাবটি গৃহীত হয় । এই প্রস্তাবই ঐতিহাসিক ‘লাহোর প্রস্তাব' বা 'পাকিস্তান প্রস্তাব' নামে পরিচিত।
লাহোর প্রস্তাবের মূল বক্তব্য বা বৈশিষ্ট্য ছিল নিম্নরূপ-
১. ভৌগোলিক দিক থেকে সংলগ্ন এলাকাগুলোকে পৃথক অঞ্চল বলে গণ্য করতে হবে ।
২. এসব অঞ্চলের ভৌগোলিক সীমানা প্রয়োজনমত পরিবর্তন করে ভারতবর্ষের উত্তর-পশ্চিম ও পূর্বাঞ্চলের যে সকল স্থানে মুসলমানরা সংখ্যাগরিষ্ঠ, সেখানে ‘স্বাধীন রাষ্ট্রসমূহ” প্রতিষ্ঠা করতে হবে ।
৩. এ সমস্ত স্বাধীন রাষ্ট্রের অঙ্গরাজ্য হবে সার্বভৌম ও স্বায়ত্ত্বশাসিত ।
৪ . ভারতের ও নবগঠিত মুসলিম রাষ্ট্রের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সাংস্কৃতিক, শাসনতান্ত্রিক ও অন্যান্য অধিকার ও স্বার্থ সংরক্ষণের কার্যকর ব্যবস্থা করা হবে ।
৫. দেশের যেকোনো ভবিষ্যৎ শাসনতান্ত্রিক পরিকল্পনায় উক্ত বিষয়গুলোকে মৌলিক নীতি হিসেবে গ্রহণ করতে হবে।
লাহোর প্রস্তাবের কোথাও ‘পাকিস্তান' কথাটি না থাকলেও এটি 'পাকিস্তান প্রস্তাব' নামে পরিচিতি লাভ করে । লাহোর প্রস্তাবে কার্যত ভারতের সন্নিহিত মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চলগুলো নিয়ে পৃথক পৃথক রাষ্ট্র গঠনের চিন্তা করা হয় ।
১৯৪৬ সালে জিন্নাহর নেতৃত্বে 'দিল্লি মুসলীম লেজিসলেটরস কনভেনশন'-এ মুসলমানদের একাধিক রাষ্ট্র- পরিকল্পনাকে বাদ দিয়ে এক পাকিস্তান পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। সে অনুযায়ী ১৯৪৭ সালের ১৪ই আগস্ট ভারত বিভক্ত হয়ে দুটি স্বাধীন রাষ্ট্রে রূপান্তরিত হয় । ভারত উপমহাদেশের মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ উত্তর- পশ্চিমাঞ্চল ও পূর্বাঞ্চল নিয়ে সৃষ্টি হয় পাকিস্তান ও বাকি অংশ নিয়ে ভারত ইউনিয়ন ।
১৯৪০ সালের ‘লাহোর প্রস্তাব' ও জিন্নাহর ‘দ্বিজাতি তত্ত্ব’ পাকিস্তান সৃষ্টির মূলভিত্তি ছিল। এর উপর ভিত্তি করে ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান রাষ্ট্রের উদ্ভব। পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান নিয়ে গঠিত পাকিস্তান রাষ্ট্রের দুই অংশ প্রায় এক হাজারের অধিক মাইল ভারতীয় ভূখণ্ড দ্বারা বিভক্ত ছিল। রাষ্ট্রের সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালিদের ভাষা-সংস্কৃতি, ইতিহাস-ঐতিহ্য, পোশাক-পরিচ্ছদ, খাদ্যাভ্যাস ছিল পশ্চিম পাকিস্তানিদের চেয়ে সম্পূর্ণ আলাদা । পশ্চিম পাকিস্তানি বিশেষ করে পাঞ্জাবিরা মনে করত, তাদের পূর্ব পুরুষেরা ভারতবর্ষের বাইরে থেকে আগত এবং তাদের ধমনিতে রয়েছে অভিজাতের রক্ত। এই ধরনের মানসিকতার কারণে পশ্চিম পাকিস্তানিরা বাঙালি মুসলমানদের অবহেলার চোখে দেখত ৷
ফলে পাকিস্তান রাষ্ট্রের শুরু থেকেই পূর্ব বাংলায় পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী এক ধরনের অভ্যন্তরীণ বৈষম্যমূলক শাসন প্রতিষ্ঠা করেছিল। এই শাসনকালে বাঙালিদের অবস্থা ছিল অনেকটা নিজ দেশে পরবাসীর মতো । পূর্ব বাংলার বাঙালিদের উপর পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর বৈষম্যমূলক আচরণের প্রথম বহিঃপ্রকাশ ঘটে রাষ্ট্রভাষা প্রশ্নে। সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালিদের ভাষা বাংলার পরিবর্তে পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী তাদের ভাষা উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাঙালিদের উপর চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে।
মাতৃভাষার অধিকার গুরুত্বপূর্ণ নাগরিক অধিকার । পাকিস্তানের শতকরা ৫৬ জনের মাতৃভাষা ছিল বাংলা; উর্দু কোনো অঞ্চলেরই মাতৃভাষা ছিল না । অথচ উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে চাপিয়ে দেওয়ার প্রচেষ্টা চালানো হয় । অগণতান্ত্রিকভাবে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে চাপিয়ে দেওয়ার প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে বাঙালিদের যে আন্দোলন শুরু হয়, তা-ই ভাষা আন্দোলন নামে পরিচিত। পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যে ইতিহাস, ঐতিহ্য, ভাষা ও সংস্কৃতি-কোনো কিছুরই মিল ছিল না। তবু শুধু ধর্মের ভিত্তিতে পূর্ব বাংলাকে পাকিস্তান রাষ্ট্রের অর্ন্তভূক্ত করা হয়। ফলে পাকিস্তান নামক এই নতুন রাষ্ট্রটির শাসকগোষ্ঠী পূর্ব বাংলাকে শোষণের প্রথম কৌশলটি গ্রহণ করে ভাষাকে কেন্দ্র করে। ১৯৪৭ সালের ডিসেম্বর মাসে করাচিতে অনুষ্ঠিত শিক্ষা সম্মেলনে উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব গ্রহণ করা হলে পূর্ব বাংলায় রাজনৈতিক নেতৃত্ব, বুদ্ধিজীবী ও ছাত্র নেতৃত্বের সমন্বয়ে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। তাদের দাবি ছিল বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করা। যে কারণে আমরা দেখি, ১৯৪৮ সালের ২৩শে ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান গণপরিষদে শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত উর্দু ও ইংরেজির পাশাপাশি বাংলাকে পরিষদের ব্যবহারিক ভাষা হিসেবে গ্রহণের দাবি করে প্রথম আনুষ্ঠানিকভাবে প্রস্তাব উত্থাপন করেন। কিন্তু শুরু থেকেই পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে গ্রহণ করতে সম্মত ছিল না। কিন্তু ততদিনে পূর্ব পাকিস্তানে শেখ মুজিবুর রহমান, মওলানা ভাসানী, অলি আহাদ প্রমূখ নেতৃবৃন্দের মতো যোগ্য, প্রতিবাদী ও অধিকার সচেতন নেতৃত্ব তৈরি হয়েছে।
তরুণ ও আদর্শিক শেখ মুজিব পূর্ব বাংলার অধিকার সংশ্লিষ্ট এবং ন্যয়সঙ্গত সকল আন্দোলনে সক্রিয় থেকে হয়ে উঠেছিলেন বাঙালির প্রাণের নেতা। বিষয়টি পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীরও নজর এড়ায়নি। ফলে সামনের সারির প্রবীণ নেতাদের চেয়েও শেখ মুজিবুর রহমানকে কঠোর গোয়েন্দা নজরদারির মধ্যে রাখা হয়। শেখ মুজিবুর রহমানের উপর সে সময়ের পাকিস্তান ইন্টেলিজেন্স ব্রাঞ্চের গোপন নথি নিয়ে ইতোমধ্যেই প্রকাশিত হয়েছে 'সিক্রেট ডকুমেন্টস অব ইনটেলিজেন্স ব্রাঞ্চ অন ফাদার অব দ্যা নেশন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১ম ও ২য় খণ্ড। প্রথম খশুটির সময়কাল ১৯৪৮-১৯৫০ এবং দ্বিতীয় খণ্ডটির সময়কাল ১৯৫১-১৯৫২। খ দু'টোর গোয়েন্দা রিপোর্টেই ভাষা আন্দোলনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের সক্রিয় সম্পৃক্ততার বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে উঠে।
১৯৪৮ সালের ২ মার্চ, বাংলাভাষা-বিরোধী কার্যকলাপের বিরুদ্ধে সক্রিয় আন্দোলন গড়ে তোলার উদ্দেশে ফজলুল হক মুসলিম হলে তমদ্দুন মজলিশ ও মুসলিম লীগের যৌথ সভায় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। এখানেও সক্রিয় ভূমিকায় ছিলেন তরুণ নেতা শেখ মুজিবুর রহমান । ৪ মার্চ ঢাকা জেলা গোয়েন্দা তথ্যে বলা হয়, 'শেখ মুজিবুর রহমানসহ যারা মুসলিম ছাত্রলীগ গঠনে কাজ করেছে তারাই বাংলাকে পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে লিফলেট ছাড়াচ্ছে।' রাষ্ট্র ভাষা আন্দোলনে ১১ মার্চের হরতাল কর্মসূচি চলাকালে তিনি গ্রেপ্তার হন। মোনায়েম সরকার সম্পাদিত বাংলা একাডেমি প্রকাশিত ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান : জীবন 'ও রাজনীতি' শীর্ষক গ্রন্থে বলা হয়েছে, ‘স্বাধীন পাকিস্তানের রাজনীতিতে এটিই তাঁর প্রথম গ্রেপ্তার।' এদিন আরও গ্রেপ্তার হয়েছিলেন শামসুল হক, অলি আহাদসহ অনেকেই।
১৯৫৩ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি ঢাকায় বঙ্গবন্ধু ও মওলানা ভাসানীর প্রভাতফেরি গোপন দলিলে শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের কয়েকটি চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। সেখানে উল্লেখ করা হয়েছে আদালতের ভাষা হিসেবে বাংলাকে গ্রহণ ও চালু করার বিষয়ে বঙ্গবন্ধু তাঁর একাধিক ভাষণে জোর দিয়েছেন। অর্থাৎ বাঙালির প্রিয় নেতা বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তানী শাসকরা শুরুতেই চিহ্নিত করতে পেরেছিল।
১৯৪৮ সালের ২১শে মার্চ ঢাকায় প্রথম সফরে এসে রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা জিন্নাহ ঘোষণা করেন, 'উর্দু এবং একমাত্র উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা ।' ঐ ঘোষণার তাৎক্ষণিক প্রতিবাদকারীদের মধ্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন অন্যতম। আন্দোলনের সূচনা ও তা সংগঠিত করতে তিনি কার্যত নেতৃস্থানীয় ভূমিকা পালন করেন । যে কারণে তাঁকে একাধিকবার কারাভোগ করতে হয় । জিন্নাহর ঢাকা সফরে আসার পূর্বে পূর্ব বাংলার মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দীনের সঙ্গে ছাত্র নেতৃবৃন্দের একটি ৮-দফা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এই চুক্তিতে বাংলা ভাষাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে মর্যাদা দেওয়ার বিষয়ে উদ্যোগ গ্রহণের সিদ্ধান্ত হয়। ২৪শে মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে জিন্নাহ ভাষাসংক্রান্ত তার পূর্ব ঘোষণার পুনরাবৃত্তি করেন । তার এ ঘোষণাকে কেন্দ্র করে শুরু হয় ভাষা আন্দোলনের দ্বিতীয় বা চূড়ান্ত পর্ব। গাজী গোলাম মাহবুবকে আহ্বায়ক করে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়। এর পূর্বে আব্দুল মতিনকে আহবায়ক করে গঠিত হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটি । খাজা নাজিমুদ্দীন কর্তৃক ২৬শে জানুয়ারি, ১৯৫২ উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার নতুন ঘোষণা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পূর্ব বাংলার ছাত্রসমাজ বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠে । বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও মহিউদ্দিন আহমদ ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা' এবং রাজবন্দীদের মুক্তির দাবিতে বন্দী অবস্থায় ১৬ই ফেব্রুয়ারি থেকে আমরণ অনশন শুরু করেন, যা আন্দোলনে নতুন মাত্রা যুক্ত করে। ২১শে ফেব্রুয়ারি ছাত্রসমাজের পক্ষ থেকে সমগ্র পূর্ব বাংলায় সাধারণ ধর্মঘট ও বিক্ষোভ সমাবেশ পালনের কর্মসূচি ঘোষণা করা হয় ।
এ সময়ে জাতীয় নেতা সোহরাওয়ার্দীর উর্দুর পক্ষে অবস্থান নিয়ে বিবৃতি (২৯ জুন, ১৯৫২, ইত্তেফাক) বিষয়ে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘সে সময় শহীদ সোহরাওয়ার্দীর ভাষা সংক্রান্ত বিবৃতি প্রকাশিত হওয়ায় আমরা বেশ অসুবিধায় পড়ি। তাই ঐ বছর জুন মাসে আমি তাঁর সঙ্গে দেখা করার জন্য করাচি যাই এবং তাঁর কাছে পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করে বাংলার দাবির সমর্থনে তাকে একটি বিবৃতি দিতে বলি' ।
ভাষা সংক্রান্ত বিষয়ে সোহরাওয়ার্দীর অবস্থান পরিবর্তনে শেখ মুজিবুর রহমান সফল হয়েছিলেন। ১৯৫২ সালে দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকায় মওলানা ভাসানীর একটি বিবৃতি প্রকাশিত হয়। সেখানে তিনি বলেন, “বাংলা ভাষার পক্ষে শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মত পরিবর্তনে মুজিব সক্ষম না হলে শুধু ভাষা আন্দোলন নয়—আওয়ামী লীগের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়তো।”
সরকার কর্তৃক ২১শে ফেব্রুয়ারির আগের দিন ঢাকা শহরে ১৪৪ ধারা জারি করে সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ করা হয় । পূর্ব ঘোষিত কর্মসূচি অনুযায়ী ছাত্ররা একুশে ফেব্রুয়ারির দিন ১৪৪ ধারা উপেক্ষা করে সমাবেশ অনুষ্ঠান ও মিছিল বের করে । মিছিলে পুলিশ গুলি চালায় । গুলিতে শহীদ হন সালাম, বরকত, জব্বারসহ আরও অনেকে। আন্দোলনের তীব্রতায় পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে মেনে নিতে বাধ্য হয় । ১৯৫৬ সালের সংবিধানে তা স্বীকৃত হয়। বাঙালিরাই পৃথিবীতে একমাত্র জাতি, যারা ভাষার দাবিতে জীবন দিয়েছে । অর্থাৎ ১৯৪৭ সালে ভাষার অধিকার চেয়ে যে যাত্রা শুরু করেছিলেন, এরপর আর থেমে থাকেননি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। আমৃত্যু তিনি বাংলা ভাষার গৌরব ও মর্যাদা অক্ষুণ্ণ রাখার চেষ্টা করেছেন। পৃথিবীর প্রথম বাঙালি হিসেবে বঙ্গবন্ধু ১৯৭৪ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর, জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের বার্ষিক অধিবেশনে বাংলায় বক্তৃতা দেন।
মানুষের ব্যক্তিত্ব তার নেতৃত্বকে সমৃদ্ধ করে। স্বভাবসুলভ ভাষা নাগরিককে আকৃষ্ট করে। বঙ্গবন্ধুর বিশুদ্ধ ভাষা ও সুস্পষ্ট উচ্চারণ ঐতিহাসিক ৭ মার্চের (১৯৭১) ভাষণকে শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছে।
এছাড়া জাতিসংঘে প্রথম বাংলা ভাষায় বক্তৃতা দিয়েছিলেন বাংলাদেশের স্থপতি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এভাবেই বাঙালি বিভিন্নভাবে নিজেদের অস্তিত্ব ঘোষণা করেছে। রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলা ভাষার সাংবিধানিক স্বীকৃতির যে জয়যাত্রা শুরু হয়েছিল পাকিস্তান আমলে, সে ধারারই সার্থক পরিণতি হলো আমাদের মাতৃভাষার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি।
আন্তর্জাতিক এই স্বীকৃতি আদায়ের জন্য প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে কানাডার ভ্যাঙ্কুভার-এ বসবাসরত Mother Language Lover of the World নামের একটি বহুভাষী ও বহুজাতিক ভাষাপ্রেমী গ্রুপ ১৯৯৮ সালের ২৮ মার্চ জাতিসংঘের মহাসচিব কফি আনান-এর কাছে একটি আবেদনপত্র পেশ করে। যার নেতৃত্বে ছিলেন প্রবাসী বাঙালি রফিকুল ইসলাম ও তাঁর সহযোগী আব্দুস সালাম। জাতিসংঘের নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকারের আন্তর্জাতিক চুক্তির ২৭ ধারার উপর ভিত্তি করে আবেদনপত্রে বিভিন্ন ভাষাভাষী ১০ জন স্বাক্ষর করেন এবং উল্লেখ করেন যে, দক্ষিণ আমেরিকা, এশিয়া, এবং আফ্রিকা মহাদেশের অসংখ্য জাতিগোষ্ঠীকে মাতৃভাষা ব্যবহার না করার জন্য, মাতৃভাষা ভুলে যাওয়ার জন্য বাধ্য করা হচ্ছে। বল প্রয়োগ করা হচ্ছে। যা ‘সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অধিকার বিষয়ক আন্তর্জাতিক সনদ'-এর সরাসরি লঙ্ঘন। পত্রে তারা প্রতিটি জাতিগোষ্ঠীর মাতৃভাষা সংরক্ষণের গুরুত্ব অনুধাবনের জন্য বাঙালির ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারির রক্তাক্ত পটভূমি তুলে ধরেন। যা সারা পৃথিবী জুড়ে অনন্য ।
তারা ২১ শে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য আবেদন জানান । যাতে প্রতিটি জাতিগোষ্ঠী তাদের মাতৃভাষাকে শ্রদ্ধা ও সম্মান জানানোর জন্য একটি বিশেষ দিবস পাবে। এ আবেদনের বিষয়টি বাংলাদেশের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অবগত হলে এ ব্যাপারে দ্রুত ও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য শিক্ষামন্ত্রী ও শিক্ষা সচিবকে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেন। ফলে অতি দ্রুততার সাথে বাংলাদেশ ইউনেস্কো জাতীয় কমিশন, শিক্ষামন্ত্রী ও মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অনুমোদনক্রমে প্রস্তাবটি যথাসময়ে পেশ করে। ইউনেস্কো তথা জাতিসংঘ বাংলাদেশের প্রস্তাবটি মেনে নেয় ।
১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের সম্মেলনে সদস্য রাষ্ট্রসমূহের সর্বসম্মতিক্রমে ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করে এবং সকল সদস্য রাষ্ট্রকে দিবসটি উদ্যাপনের জন্য প্রস্তাব গৃহীত হয়। ফলে ১৯৫২ সাল থেকে যে ২১শে ফেব্রুয়ারি শুধু আমাদের ছিল, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতির মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের অহংকার, বাঙালির ভাষা সারাবিশ্বে জায়গা করে নেয়। বাংলাদেশে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদ্যোগেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইন্সটিটিউট। ২০১০ সাল থেকে ২১ ফেব্রুয়ারি সারাবিশ্বে আর্ন্তজাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালিত হচ্ছে। এখন ২১ শে ফেব্রুয়ারি এবং বাংলাভাষা পৃথিবীর সকল দেশ-জাতির মাতৃভাষারও প্রতিনিধিত্ব করছে।
ধর্মভিত্তিক জাতীয় পরিচয়ের ভিত্তিতে পাকিস্তান সৃষ্টি হলেও ভাষা আন্দোলনে আত্মদানের মধ্য দিয়ে ধর্মীয় পরিচয়ের বাইরেও ভাষার ভিত্তিতে বাঙালিরা এক জাতিসত্তার পরিচয়ে পরিচিত হয়। অর্থাৎ ভাষা আন্দোলন বাংলার মানুষের নিজেদের অধিকারের চেতনার জায়গাটি তৈরি করে এবং বাঙালী জাতীয়তাবাদ বিকাশ লাভ করে। এই চেতনা, এ জাতীয়তাবাদ বাংলাদেশকে পাকিস্তানের উপনিবেশ হতে দেয়নি। বরং জাতীয় মুক্তির আকাঙ্ক্ষা আরও বেগবান হয় ।
১৯৫৪ সালের মার্চ মাসে পূর্ব বাংলার প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় । প্রাদেশিক পরিষদের মোট আসন সংখ্যা ছিল ৩০৯ । ১৯৫৩ সালের নভেম্বর মাসে আওয়ামী লীগসহ সমমনা কতিপয় দল নিয়ে ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগ সরকারের বিরুদ্ধে 'যুক্তফ্রন্ট' নামে একটি নির্বাচনি জোট গঠিত হয় । ভাষা আন্দোলনের পর ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের বিজয় পূর্ব বাংলার নাগরিকদের রাজনৈতিক চেতনাকে আরো সমৃদ্ধ করে ।
নির্বাচনের প্রাক্কালে যুক্তফ্রন্ট সর্বস্তরের ভোটারদের আকৃষ্ট করতে ২১ দফাবিশিষ্ট একটি কর্মসূচি গ্রহণ করে যেখানে বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দান, ভাষাশহীদদের স্মরণে শহীদ মিনার নির্মাণ, ভূমিহীন কৃষকদের মধ্যে উদ্বৃত্ত জমি বিতরণ, পাট ব্যবসা জাতীয়করণ ইত্যাদি অন্তর্ভূক্ত করা হয়। এসব দাবি ছিল পূর্ব বাংলার জনগণের নাগরিক অধিকার প্রতিষ্ঠার সাথে সরাসরি সম্পর্কিত। এই নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট ২৩৭টি মুসলিম আসনের মধ্যে ২২৩টি আসনে জয়লাভ করে। অন্যদিকে, পাকিস্তান আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী দল মুসলিম লীগ মাত্র ৯টি আসন পায় ।
১৯৫৪ সালের নির্বাচনে জয়লাভের পর শেরে বাংলা একে ফজলুল হককে মুখ্যমন্ত্রী করে যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভা গঠন করা হয়। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী যুক্তফ্রন্টের হাতে মুসলিম লীগের শোচনীয় পরাজয় মেনে নিতে পারেনি। যার ফলে মাত্র ৫৬ দিনের মধ্যে যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভা ভেঙ্গে দেয়া হয় এবং পূর্ব বাংলায় গভর্নরের শাসন জারি করা হয় ।
স্বাধীনতার দীর্ঘ ৯ বছর পর ১৯৫৬ সালে সর্বপ্রথম পাকিস্তানের জন্য একটি সংবিধান প্রণয়ন করা হয় । এ সংবিধানে বাঙালিদের কতিপয় দাবি বিশেষ করে বাংলাকে রাষ্ট্রের অন্যতম ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। কিন্তু ১৯৫৮ সালের ৭ই অক্টোবর জেনারেল ইস্কান্দার মির্জার সামরিক শাসন ঘোষণার মাধ্যমে তা বাতিল হয়ে যায়। আবার তিন সপ্তাহের মধ্যে ইস্কান্দার মীর্জাকে সরিয়ে জেনারেল আইয়ুব খান ক্ষমতা দখল করেন । তিনি সর্বজনীন ভোটাধিকার ভিত্তিক পশ্চিমা গণতন্ত্রের ধারণা প্রত্যাখ্যান করে ‘মৌলিক গণতন্ত্রের' ধারণা প্রবর্তন করেন ।
১৯৫৯ সালের ২৬শে অক্টোবর জেনারেল আইয়ুব খান তার ‘মৌলিক গণতন্ত্র আদেশ' ঘোষণা করেন । মৌলিক গণতন্ত্র ব্যবস্থাধীনে পাকিস্তানের উভয় অংশ থেকে ৪০,০০০ (চল্লিশ হাজার) করে মোট ৮০,০০০ (আশি হাজার) ইউনিয়ন কাউন্সিল সদস্য নিয়ে দেশের নির্বাচকমণ্ডলী গঠিত হয়। এরা মৌলিক গণতন্ত্রী নামে পরিচিত ছিলেন। তাদের ভোটে রাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট, জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যবৃন্দ নির্বাচনের বিধান রাখা হয়। মৌলিক গণতন্ত্র আদেশে নাগরিকদেরকে প্রত্যক্ষ ভোটের অধিকার থেকে বঞ্চিত করে এক ধরনের পরোক্ষ নির্বাচন পদ্ধতি প্রবর্তন করা হয়। এ ধরনের নির্বাচনী ব্যবস্থার কারণে পূর্ববাংলার জনপ্রিয় রাজনৈতিক নেতৃত্ব নির্বাচিত হওয়ার সুযোগ হারায়। এ সময় রাজনৈতিক দল সকল সভা-সমাবেশ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। পাকিস্তানের জনপ্রিয় রাজনৈতিক নেতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীসহ মোট ৭৮ জন রাজনীতিককে কালো আইনের আওতায় একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত কোনোরূপ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা থেকে বিরত রাখা হয়।
১৯৫৮ সালে পাকিস্তানের ক্ষমতা দখল করার পর থেকে ১৯৬২ সালের জুন পর্যন্ত জেনারেল আইয়ুব খানের নেতৃত্বে সামরিক শাসন বহাল থাকে । তিনি একটানা ৪৪ মাস সামরিক আইন দ্বারা দেশ পরিচালনা করেন। ১৯৬২ সালে জেনারেল আইয়ুব খান নিজস্ব ধ্যান-ধারণা নির্ভর একটি নতুন শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করেন। তাতে সংসদীয় সরকার এবং প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের ধারা বাদ দিয়ে রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকারের বিধান রাখা হয় । রাষ্ট্রপতিকে এই ব্যবস্থার কেন্দ্রবিন্দুতে রেখে অসীম ক্ষমতাধর এক ব্যক্তির শাসন প্রতিষ্ঠা করা হয় ।
১৯৬২ সালে সামরিক শাসক আইয়ুব খানের সময়কালে শিক্ষা নীতি প্রণয়নের জন্য ‘শরীফ শিক্ষা কমিশন' গঠন করা হয়েছিল। উক্ত কমিশনের রিপোর্টে ৬ষ্ঠ শ্রেণি থেকে ডিগ্রি পর্যন্ত ইংরেজি পাঠ বাধ্যতামূলক, উর্দুকে জনগণের ভাষায় পরিণত করা এবং একই সাথে জাতীয় ভাষার জন্য একটি সাধারণ বর্ণমালা প্রবর্তনের চেষ্টা এবং সেক্ষেত্রে আরবির গ্রহণযোগ্যতা বিবেচনা, রোমান বর্ণমালার সাহায্যে পাকিস্তানি ভাষাসমূহকে লেখা, শিক্ষা খরচ শিক্ষার্থীদের বহন করা, ডিগ্রি কোর্সকে তিন বছর মেয়াদি করা ইত্যাদি সুপারিশ করা হয় । ছাত্ররা এই রিপোর্ট প্রত্যাখ্যান করে আন্দোলনে নামে । আন্দোলন চলাকালে ১৯৬২ সালে ১৭ই সেপ্টেম্বর পুলিশের গুলিতে শহীদ হন ছাত্রনেতা মোস্তফা ওয়াজিউল্লাহ, বাবুল প্রমুখ। ৬২'র শিক্ষা আন্দোলনের গুরুত্ব রাজনৈতিকভাবেও অপরিসীম।
পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠিত হবার পর শাসক গোষ্ঠী রাজনৈতিক, প্রশাসনিক, সামরিক, অর্থনৈতিক, শিক্ষা প্রভৃতি ক্ষেত্রে পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি বৈষম্য ও নিপীড়নমূলক নীতি অবলম্বন করে। এ সময়ে সামরিক সরকার সংবাদপত্রের কন্ঠরোধ করে এবং কালো আইনের আওতায় রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ করে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে বাঁধাগ্রস্থ করে। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী সামরিক ও বেসামরিক প্রশাসনে নিয়োগের ক্ষেত্রে বৈষম্যমূলক নীতি অবলম্বন করে । ফলে সামরিক ও বেসামরিক প্রশাসনে শীর্ষ পদে পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিনিধিত্ব ছিল অতি নগণ্য। দেশের সামরিক বাজেটের সিংহভাগ দায়ভার পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ বহন করলেও এ অঞ্চলের প্রতিরক্ষার বিষয় চরমভাবে অবহেলিত হয়েছে। শিক্ষা ক্ষেত্রেও ছিল চরম বৈষম্য। ১৯৫৫ থেকে ১৯৬৭ সাল পর্যন্ত পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য শিক্ষা খাতে বরাদ্দ ছিল ২০৮৪ মিলিয়ন রুপি, অপরদিকে পূর্ব পাকিস্তানের জন্য বরাদ্দ ছিল মাত্র ৭৯৭ মিলিয়ন রুপি ।
শুরুতে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যে পূর্ব বাংলার অবস্থা ছিল অপেক্ষাকৃত ভালো। কিন্তু এই অবস্থা বেশি দিন টিকে থাকেনি। ক্রমান্বয়ে দুই অংশের মধ্যে বৈষম্য সৃষ্টি এবং ব্যবধানের মাত্রা বৃদ্ধি পেতে থাকে। দেশের উন্নয়ন পরিকল্পনায় পশ্চিম পাকিস্তানীর জন্য অধিক ব্যয় বরাদ্দ করা হতো। অপরদিকে মোট সরকারি ব্যয়ের অল্প পরিমাণে বরাদ্দ করা হতো পূর্ব পাকিস্তানিদের জন্য। ১৯৬৮ সালের এপ্রিল মাসে পাকিস্তান প্লানিং কমিশনের প্রধান অর্থনীতিবিদ মাহবুবুল হক তথ্য প্রকাশ করেন যে, দেশের শতকরা ৬৬ ভাগ শিল্প, ৭৯ ভাগ বীমা এবং ৮০ ভাগ ব্যাংক সম্পদ মাত্র ২২টি পরিবারের হাতে (যার মধ্যে ১টি বাদে বাকি সব পশ্চিম পাকিস্তানি) কেন্দ্রীভূত । জেনারেল আইয়ুব খানের এক দশকের শাসন আমলে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক সাহায্য পাওয়া যায় । এর সিংহভাগ পশ্চিম পাকিস্তানে খরচ হয় । পাকিস্তানের পূর্ব অংশের পুঁজি পশ্চিম অংশে পাচার হয়ে যায় ।
পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি এমন অন্যায় ও বৈষম্যমূলক কর্মকাণ্ডকে সামনে রেখে ১৯৬৬ সালের ৫-৬ই ফেব্রুয়ারি পশ্চিম পাকিস্তানের লাহোরে বিরোধী দলের এক কনভেনশন অনুষ্ঠিত হয়। ঐ কনভেনশনে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর ঐতিহাসিক ৬ দফা কর্মসূচি উত্থাপন করেন ।
৬ দফা কর্মসূচি ছিল সংক্ষেপে নিম্নরূপ-
দফা-১ : লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে পাকিস্তান হবে একটি ফেডারেশন বা যুক্তরাষ্ট্র। সর্বজনীন ভোটাধিকারের ভিত্তিতে প্রত্যক্ষভাবে নির্বাচিত আইন পরিষদের প্রাধান্যসহ সংসদীয় পদ্ধতির সরকার গঠনের ব্যবস্থা থাকতে হবে ।
দফা-২ : বৈদেশিক সম্পর্ক ও প্রতিরক্ষা ছাড়া সকল বিষয় স্টেট বা প্রদেশের হাতে ন্যস্ত থাকবে । উল্লেখিত দু'টি বিষয় ন্যস্ত থাকবে কেন্দ্রীয় বা যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারের হাতে ।
দফা-৩ : পাকিস্তানের দু'টি অঞ্চলের জন্য পৃথক অথচ অবাধে বিনিময়যোগ্য মুদ্রাব্যবস্থার প্রবর্তন করতে হবে । অথবা সমগ্র দেশে একটি মুদ্রাব্যবস্থা থাকবে, তবে সে ক্ষেত্রে পূর্ব পাকিস্তান থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে মূলধন পাচার রোধের কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এজন্য একটি ফেডারেল ব্যাংকের অধীনে কার্যকরী ব্যবস্থা থাকতে হবে ।
দফা-৪ : অঙ্গরাজ্য বা প্রদেশগুলোর কর বা শুল্ক ধার্য করার ক্ষমতা থাকবে। তবে ব্যয় নির্বাহের জন্য কেন্দ্রীয় সরকার এর একটি অংশ পাবে ।
দফা-৫ : পাকিস্তানের দুই অঞ্চলের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের পৃথক হিসাব রাখা হবে । অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রা স্ব স্ব অঞ্চলের বা অঙ্গরাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণে থাকবে । এছাড়া কেন্দ্রীয় সরকারের বৈদেশিক নীতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে অঙ্গরাজ্যগুলো বিদেশে বাণিজ্য প্রতিনিধি প্রেরণ এবং যেকোনো চুক্তি সম্পাদন করতে পারবে।
দফা-৬ : নিজস্ব নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য অঙ্গরাষ্ট্রসমূহ প্যারামিলিশিয়া বা আধাসামরিক বাহিনী গড়ে তুলতে পারবে ।
ছয় দফার গুরুত্ব:
১৮-২০ শে মার্চ, ১৯৬৬ সালে আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটিতে ছয় দফা গৃহীত হওয়ার পর বঙ্গবন্ধু ছয় দফার পক্ষে জনমত গড়ে তোলার জন্য বিভিন্ন স্থানে ২০ মার্চ থেকে ৮ মে পর্যন্ত ৩২ টি জনসভায় বক্তব্য দেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক উপস্থাপিত ৬ দফা কর্মসূচি ছিল বাঙালির জাতীয় মুক্তির সনদ বা ‘ম্যাগনাকার্টা'। কার্যত এই ৬ দফার মধ্য দিয়ে পাকিস্তানি ধাঁচের বৈষম্যমূলক রাষ্ট্রব্যবস্থাকে ভেঙে বাঙালির জাতীয়-মুক্তি বা স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্য স্থির হয় । জেনারেল আইয়ুব খান ৬ দফাকে ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী,’ ‘বৃহত্তর বাংলা প্রতিষ্ঠার' কর্মসূচি হিসেবে আখ্যায়িত করেন এবং তা নস্যাৎ করতে যেকোনো ধরনের শক্তি প্রয়োগের হুমকি দেন ।
৬ দফার সংগ্রামকে ব্যর্থ করে দেওয়ার লক্ষ্যে ১৯৬৮ সালের জানুয়ারি মাসে আইয়ুব সরকার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে এক নম্বর আসামী করে ৩৫ জন বাঙালি সামরিক-বেসামরিক ব্যক্তির বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতামূলক একটি মামলা দায়ের করে, যা ঐতিহাসিক আগরতলা মামলা নামে পরিচিত। এর আনুষ্ঠানিক নাম ছিল 'রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিবুর রহমান ও অন্যান্য'। এই মামলায় বঙ্গবন্ধুকে প্রধান আসামি করা হয়। কিন্তু আগরতলা মামলাকে কেন্দ্র করে বাঙালিদের মধ্যে জাতীয়তাবাদী চেতনা আরো জোরদার হয়।
বঙ্গবন্ধুসহ ৬ দফাপন্থী অন্যান্য আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ জেলে বন্দী থাকায় বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলনের নেতৃত্বভার সচেতন ছাত্রসমাজের উপর গিয়ে বর্তায়। ১৯৬৯ সালের জানুয়ারি মাসের প্রথম দিকে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ, পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন (মেনন ও মতিয়া উভয় গ্রুপ), সরকারি ছাত্র সংগঠন জাতীয় ছাত্র ফেডারেশনের দোলন গ্রুপ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদ (ডাকসু) ঐক্যবদ্ধ হয়ে আইয়ুববিরোধী মঞ্চ, কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠন করে। ডাকসুর তৎকালীন সহ-সভাপতি অনলবর্ষী ছাত্রনেতা তোফায়েল আহমদ এর সভাপতি নির্বাচিত হন । বঙ্গবন্ধু ঘোষিত ৬ দফা কর্মসূচির প্রতি সর্বাত্মক সমর্থনসহ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ তাদের ১১ দফা কর্মসূচি ঘোষণা করে । ফলে যে উদ্দেশ্যে আইয়ুব খান আগরতলা মামলা দায়ের করেছিল তা সফল হয়নি। বরং বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তারের পর ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ জাতীয় রাজনীতির গুরুত্বপূর্ণ বিষয়সমূহ অন্তর্ভুক্ত করে ১১ দফা ভিত্তিক একটি কর্মসূচি গ্রহণ করে । এই কর্মসূচি পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের জাতীয় মুক্তির বা স্বাধীনতার লক্ষ্যকে এগিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করে। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ আগরতলা মামলা প্রত্যাহার এবং বঙ্গবন্ধুসহ সকল রাজবন্দীর মুক্তির দাবিতে দেশব্যাপী ছাত্র আন্দোলন শুরু করে। বস্তুত ১৯৬৮ সালের নভেম্বর মাস থেকে ১৯৬৯ সালের মার্চ পর্যন্ত পাঁচ মাস সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানে গণবিদ্রোহ দেখা দেয় । একই সময় পশ্চিম পাকিস্তানেও আইয়ুব-বিরোধী ছাত্র আন্দোলন গড়ে উঠে ।
৬ দফা ও ১১ দফার ভিত্তিতে পূর্ব বাংলার সকল শ্রেণির মানুষের মধ্যে একটি সুদৃঢ় নাগরিক ঐক্য গড়ে উঠার ভিত্তি তৈরি হয় । আগরতলা মামলা প্রত্যাহারের দাবিতে ছাত্র আন্দোলন আরও তীব্র আকার ধারণ করে । সংঘটিত হয় ৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান । গণ-অভ্যুত্থানের চূড়ান্ত পর্যায়ে ১৯৬৯ সালের ২৫শে মার্চ জেনারেল আইয়ুব খান ক্ষমতা থেকে বিদায় নিতে বাধ্য হন। আগরতলা মামলাবিরোধী গণ-অভ্যুত্থান স্বাধীন বাংলাদেশের উদ্ভবে ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করে ।
মৌলিক গণতন্ত্র, আগরতলা মামলা ও আইয়ুব শাহী নির্যাতনের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের উভয় অংশে ১৯৬৯ সালে এক দুর্বার গণ-আন্দোলন শুরু হয়। ছাত্রসমাজের ১১ দফা কর্মসূচিতে শিক্ষার সুযোগ বৃদ্ধি, আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন, প্রাপ্তবয়স্কদের ভোটাধিকার, বাক-স্বাধীনতা, বৃহৎ শিল্প জাতীয়করণ, কৃষক-শ্রমিকের সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি, নিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতি, জরুরি নিরাপত্তা আইন প্রত্যাহার, রাজবন্দীদের মুক্তি প্রভৃতি দাবি অন্তর্ভুক্ত ছিল । পশ্চিম পাকিস্তানে এক ইউনিট বাতিল এবং পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য সকল বিরোধী দল ঐক্যবদ্ধ হয়। এ সময় পশ্চিম পাকিস্তানে পুলিশের গুলিতে কয়েকজন ছাত্র নিহত হয়। এ হত্যার প্রতিবাদে সারা দেশে শুরু হয় গণ-আন্দোলন । বিরোধী দলগুলো গণতান্ত্রিক সংগ্রাম পরিষদ (DAC) গঠন করে । শুরু হয় দেশব্যাপী তীব্র ছাত্র গণ-আন্দোলন ।
আইয়ুব খানের পদত্যাগ, ১৯৬২ সালের সংবিধান বাতিল, ‘এক ব্যক্তি এক ভোটের' ভিত্তিতে সংসদীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা, আগরতলা মামলা প্রত্যাহার প্রভৃতি দাবিতে দেশব্যাপী গড়ে ওঠা আন্দোলন গণ-অভ্যুত্থানে রূপ নেয় । আন্দোলনের ভয়ে ভীত হয়ে আইয়ুব খান আগরতলা মামলা প্রত্যাহার করেন ।
ঐতিহাসিক আগরতলা মামলা থেকে শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তির পর ঊনসত্তরের গণআন্দোলন নুতন রূপ লাভ করে । ২৩ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯ সালে রেসকোর্স ময়দানে (সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যান) ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে শেখ মুজিবকে সংবর্ধনা দেওয়া হয়। প্রায় ১০ লাখ ছাত্র-জনতার এই সংবর্ধনা সমাবেশে শেখ মুজিবুর রহমানকে আনুষ্ঠানিকভাবে ‘বঙ্গবন্ধু' উপাধিতে ভূষিত করা হয়। তদানীন্তন ডাকসুর ভিপি ছাত্রনেতা তোফায়েল আহমেদ এ প্রস্তাব উত্থাপন করেন। ঐ সংবর্ধনা সভায় বঙ্গবন্ধু ছাত্রদের ১১ দফা দাবির প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করেন এবং ছয় দফা ও ১১ দফা বাস্তবায়নে প্রতিশ্রুতি দেন ।
১৯৬৯ সালের ২৫শে মার্চ আইয়ুব খান সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল ইয়াহিয়া খানের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করে রাজনীতি থেকে বিদায় গ্রহণ করেন । ক্ষমতাসীন হয়ে সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ইয়াহিয়া খান উদ্ভুত রাজনৈতিক সংকট সমাধানে কতগুলো গুরুত্বপূর্ণ ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। রাজনৈতিক দলের কার্যকলাপের উপর বিধিনিষেধ তুলে নেওয়ার ঘোষণা দেন। পাকিস্তানে প্রথম সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে তিনি কতিপয় শাসনতান্ত্রিক পদক্ষেপ ঘোষণা করেন । এর মধ্যে এক ব্যক্তি, এক ভোট, প্রত্যেক প্রদেশের জন্য জাতীয় পরিষদে জনসংখ্যার ভিত্তিতে আসন সংখ্যা বণ্টন নীতি ছিল অন্যতম । জাতীয় পরিষদের আসনসংখ্যা হবে ৩১৩, যার মধ্যে ১৩টি হবে সংরক্ষিত মহিলা আসন । প্রত্যেক প্রদেশের জন্য সর্বাধিক স্বায়ত্তশাসনের বিধান রাখা হয় । নির্বাচিত প্রতিনিধি কর্তৃক সংবিধান প্রণয়নের জন্য সর্বোচ্চ ১২০ দিন ধার্য করা হয় । প্রণীত সংবিধান রাষ্ট্রপতি কর্তৃক অনুমোদিত হওয়া আবশ্যকীয় করা হয় ।
১৯৭০-এর নির্বাচন ও ফলাফল:
১৯৭০ সালের নির্বাচনই ছিল পাকিস্তান রাষ্ট্রের প্রথম সাধারণ নির্বাচন । প্রাপ্তবয়স্ক এবং জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সকলের ভোটাধিকারের ভিত্তিতে এ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এ নির্বাচন দু'দফায় যথাক্রমে ৭ই ডিসেম্বর ১৯৭০ এবং ১৭ই জানুয়ারি ১৯৭১ সালে অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী উল্লেখযোগ্য রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে প্রধান দু'টি দল হচ্ছে, পূর্ব পাকিস্তানে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বাধীন ‘আওয়ামী লীগ' এবং পশ্চিম পাকিস্তানে জুলফিকার আলী ভুট্টোর নেতৃত্বাধীন ‘পাকিস্তান পিপলস পার্টি'। ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নির্বাচনি ইস্যু ছিল বাঙালি জাতির মুক্তির সনদ ৬ দফা। অপরদিকে, জুলফিকার আলী ভুট্টোর পাকিস্তান পিপলস পার্টির প্রচারণার মূল বিষয়বস্তু ছিল- ‘শক্তিশালী কেন্দ্র’, ‘ইসলামী সমাজতন্ত্র’ এবং অব্যাহত ভারত বিরোধিতা। অন্যদিকে মুসলিম লীগ ও অন্যান্য ইসলামপন্থী দল বা গ্রুপ তাদের নির্বাচনি প্রচারে পাকিস্তান পিপলস পার্টির মতো ইসলামি সংবিধান, শক্তিশালী কেন্দ্র এবং ভারত বিরোধিতার উপর গুরুত্ব আরোপ করে ।
নির্বাচনি ফলাফল:
পাকিস্তান জাতীয় পরিষদে ১৯৭০ সালের নির্বাচনের ফলাফল নিচের সারণিতে উপস্থাপিত হলো।
রাজনৈতিক দলের নাম |
সাধারণআসন পূর্বপাকিস্তান |
সাধারণ আসন পশ্চিমপাকিস্তান |
সংরক্ষিত মহিলা আসন |
উপজাতীয় এলাকার আসন
|
প্রাপ্ত মোট আসন |
আওয়ামী লীগ | ১৬০ |
— | ৭ | — | ১৬৭ |
পিপলস্ পার্টি |
— | ৮৩ | ৫ | — | ৮৮ |
মুসলীম লীগ (কাইয়ুম) |
— | ৯ | — | — | ৯ |
মুসলীমস লীগ (কাউন্সিল) | — | ৬ | ১ | — | ৭ |
ন্যাপ (ওয়ালী) | — | ২ |
— |
— | ৭ |
মুসলীম লীগ (কনভেনশন) | — | ৪ | — | — | ২ |
জামায়াতে -ইসলামী | — |
৭ |
— | — | ৪ |
জমিয়তে উলামা-ই-পাকিস্তান | — | ৭ | — | — | ৭ |
জমিয়তে উলামা-ই ইসলাম | — | — | — | — | ৭ |
পি.ডি.পি. | ১ | — | — | — | ১ |
স্বতন্ত্র নির্দলীয় | ১ | ৬ | — | ৭ | ১৪ |
সর্বমোট | ১৬২ | ১৩১ | ১৩ | ৭ | ১৩ |
রাজনৈতিক দলের নাম | সাধারণ আসন | মহিলা আসন | মোট আসন |
আওয়ামী লীগ | ২৮৮ | ১০ | ২৯৮ |
পি.ডি.পি | ২ | — | ২ |
ন্যাপ (ওয়ালী) | ১ | — | ১ |
জামায়াতে ইসলামী | ১ | — | ১ |
নেজামে ইসলাম | ১ | — | ১ |
স্বতন্ত্র নির্দলীয় | ৭ | — | ৭ |
সর্বমোট | ৩০০ | ১০ | ৩১০ |
১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশে অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনি ফলাফলে দেখা যায়, আওয়ামী লীগ পূর্ব পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের ১৬২টি এলাকাভিত্তিক আসনের মধ্যে ১৬০টি আসন লাভ করে । জাতীয় পরিষদে পূর্ব পাকিস্তানের জন্য সংরক্ষিত ৭টি মহিলা আসনসহ সর্বমোট ৩১৩ সদস্যবিশিষ্ট জাতীয় পরিষদে আওয়ামী লীগের আসন সংখ্যা দাঁড়ায় ১৬৭টি। পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের মোট ৩০০টি এলাকাভিত্তিক আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ ২৮৮টি লাভ করে। অন্য ১২টি আসনের ৯টিতে স্বতন্ত্র প্রার্থী, ২টিতে পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক পার্টি এবং একটিতে জামায়াতে-ইসলামী জয়লাভ করে । প্রাদেশিক পরিষদে মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত ১০টি আসনসহ আওয়ামী লীগের দলীয় আসন সংখ্যা দাঁড়ায় ২৯৮টি।
অপরদিকে, জাতীয় পরিষদে পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য বরাদ্দকৃত ১৩৮টি এলাকাভিত্তিক আসনের মধ্যে ৮৩ টি আসনে জুলফিকার আলী ভুট্টোর পাকিস্তান পিপলস্ পার্টি জয়লাভ করে । বাকি ৫৫টি আসনের ৯টিতে মুসলিম লীগ (কাইয়ুম খান), ৭টিতে মুসলিম লীগ (কাউন্সিল), ৭টিতে জমিয়তে উলামায়-ই-ইসলাম, ৬টিতে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি-ন্যাপ (ওয়ালী খান), ৭টিতে জমিয়তে উলামায়-ই-পাকিস্তান, ৪টিতে জামায়াতে ইসলামী, ২টিতে মুসলিম লীগ (কনভেনশন) এবং ১৩টিতে নির্দলীয় প্রার্থীগণ জয়লাভ করেন ।
পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য সংরক্ষিত ৬টি মহিলা আসনের ৫টিতে পাকিস্তান পিপলস পার্টি এবং ১টিতে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি-ন্যাপ (ওয়ালী খান) জয়লাভ করে। মহিলা আসনসহ পাকিস্তান পিপলস পার্টির মোট আসনসংখ্যা দাঁড়ায় ৮৮টি। ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসেবে আবির্ভূত হয়। আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনের মধ্য দিয়ে বাঙালিদের রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ব অর্জন এবং ৬ দফা ভিত্তিক সংবিধান প্রণয়নের বিষয়টি নিশ্চিত হয়, যার কোনোটিই পাকিস্তানি সামরিক-বেসামরিক আমলা শাসকগোষ্ঠীর কাছে গ্রহণযোগ্য ছিল না । ফলে নির্বাচনের ফলাফল প্রকাশের অব্যবহিত পরে শুরু হয় নতুন ষড়যন্ত্র। সামরিক-বেসামরিক আমলা শাসকগোষ্ঠীর এ ষড়যন্ত্রে পাকিস্তান পিপলস পার্টির নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টো সক্রিয়ভাবে যুক্ত হন। পাকিস্তানি সামরিক জান্তা একদিকে সংকট নিরসনের নামে ঢাকায় সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছিল, অন্যদিকে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে সৈন্য ও অস্ত্র আনা হচ্ছিল ।
১৯৭১ সালের ৩রা মার্চ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহ্বান করেছিলেন । নির্বাচনের পর সংখ্যাগরিষ্ঠ দল আওয়ামী লীগের নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে তিনি পাকিস্তানের ‘ভাবী প্রধানমন্ত্রী' হিসেবেও আখ্যায়িত করেছিলেন। কিন্তু এসবই ছিল লোক দেখানো । ভেতরে ভেতরে চলছিল নির্বাচনের রায় বানচাল করার ষড়যন্ত্র।
১লা মার্চ ১৯৭১ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান কর্তৃক পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত ঘোষণা করা হয়। এর প্রতিবাদে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ২রা মার্চ ঢাকায় এবং ৩রা মার্চ সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানে হরতালের ডাক দেন । কার্যত ১লা মার্চ থেকেই পাকিস্তানি শাসনের বিরুদ্ধে অসহযোগ আন্দোলন শুরু হয়। ২রা মার্চ রাতে কার্ফু জারি করা হয় । ছাত্রজনতা কার্ফু ভঙ্গ করে । সেনাবাহিনী গুলি চালায়। প্রতিদিন শতশত লোক হতাহত হয় । প্রতিবাদে-প্রতিরোধে জেগে উঠে বাংলাদেশ । উত্থান ঘটে বাঙালি জাতির। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এ জাতির পিতা। 'জয় বাংলা' এ জাতির মুক্তির ধ্বনি। চারিদিকে বিদ্রোহ আর গগনবিদারী স্লোগান : “বীর বাঙালি অস্ত্র ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর' ।
১৯৭১ সালের ২রা মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় ছাত্র-জনতার সমাবেশে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন, ৩রা মার্চ পল্টনের জনসভায় বঙ্গবন্ধুর উপস্থিতিতে ছাত্রসমাজের ‘স্বাধীন বাংলাদেশের ইশতেহার পাঠ’, ‘স্বাধীন বাংলাদেশ কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠন', ২৩শে মার্চ পাকিস্তান প্রজাতন্ত্র দিবসে পূর্ব বাংলার সর্বত্র পাকিস্তানি পতাকার পরিবর্তে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন বাঙালির জাতীয় উত্থানের স্বাক্ষর বহন করে ।
১৯৭১ সালের ২রা মার্চ থেকে ২৫শে মার্চ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আহ্বানে সারা বাংলায় সর্বাত্মক অসহযোগ পালিত হয় । পূর্ব বাংলার সকল সরকারি-বেসরকারি অফিস, সেক্রেটারিয়েট, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান, হাইকোর্ট, পুলিশ প্রশাসন, ব্যাংক-বীমা, ব্যবসা-বাণিজ্য, পরিবহন ইত্যাদি পাকিস্তান সরকারের নির্দেশ সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশে পরিচালিত হয় ।
১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ বাঙালির জাতীয় জীবনে এক অবিস্মরণীয় দিন । এদিন ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) লক্ষ জনতার স্বতঃস্ফূর্ত সমাবেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জাতির উদ্দেশ্যে এক গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ দেন । এই ভাষণে তিনি ঘোষণা দেন— “ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল। তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে। রক্ত যখন দিয়েছি রক্ত আরো দেব। এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব, ইনশাআল্লাহ। ... এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। জয় বাংলা। বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণকে ইউনেস্কো ২০১৭ সালের ৩০ অক্টোবর তারিখে প্রথম পাণ্ডুলিপিবিহীন এবং অলিখিত ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি দেয়।
১৯৭১ সালের ১৫ই মার্চ ইয়াহিয়া খান ঢাকায় আসেন। তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে আলোচনায় বসার অনুরোধ জানান। ১৬ই মার্চ থেকে আলোচনা শুরু হয়। পিপলস পার্টির নেতা জুলফিকার আলী ভূট্টোসহ পশ্চিম পাকিস্তানের কয়েকজন নেতা আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন। কিন্তু পাকিস্তানি শাসকচক্রের মূল উদ্দেশ্য ছিল আলোচনার নামে সময়ক্ষেপণ করা এবং পাকিস্তান থেকে সৈন্য ও রসদ আমদানি করে বাঙালি জাতির স্বাধীনতা সংগ্রামকে চিরতরে স্তব্ধ করে দেওয়া। ২৩শে মার্চ 'পাকিস্তান প্রজাতন্ত্র দিবসে' বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে বাংলাদেশের ঘরে ঘরে পাকিস্তানের পতাকার স্থলে স্বাধীন বাংলার জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হয়। ২৪শে মার্চ আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ সংকট সমাধানের লক্ষ্যে শেষ চেষ্টা করেন। কিন্তু ২৫শে মার্চ ইয়াহিয়া খান কোনো রকম ঘোষণা না দিয়েই সদলবলে ঢাকা ত্যাগ করেন এবং ঐ রাতেই পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে নিরস্ত্র বাঙালিদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ার নির্দেশ দেন। তারা ঢাকাসহ অন্যান্য শহরেও হাজার হাজার নিরীহ, নিরস্ত্র বাঙালিকে নির্মমভাবে হত্যা করে। এই রাতকে ইতিহাসে 'কালরাত্রি' হিসেবে অভিহিত করা হয়।
গ্রেফতার হওয়ার পূর্বমুহূর্তে ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। এ জন্যই ২৬ মার্চ আমাদের মহান স্বাধীনতা দিবস। ২৫ মার্চ রাত ১২ টার পর অর্থাৎ ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে ইপিআর-এর ট্রান্সমিটারের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু তাঁর স্বাধীনতার ঘোষণাটি দেন। বাংলাদেশের সকল স্থানে তদানীন্তন ইপিআর এর ট্রান্সমিটার, টেলিগ্রাম ও টেলিপ্রিন্টারের মাধ্যমে ঘোষণাটি প্রচার করা হয়। স্বাধীনতার ঘোষণাটি ছিল ইংরেজি ভাষায়, যাতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ঘোষণার বিষয়টি বুঝতে পারেন। ঘোষণার বাংলা অনুবাদটি নিম্নরূপ:
“ইহাই হয়তো আমার শেষ বার্তা, আজ হইতে বাংলাদেশ স্বাধীন। আমি বাংলাদেশের জনগণকে আহবান জানাইতেছি যে, যে যেখানে আছ, যাহার যাহা কিছু আছে, তাই নিয়ে রুখে দাঁড়াও, সর্বশক্তি দিয়ে হানাদার বাহিনীকে প্রতিরোধ করো। পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীর শেষ সৈন্যটিকে বাংলার মাটি হইতে বিতাড়িত না করা পর্যন্ত এবং চূড়ান্ত বিজয় অর্জন না করা পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে যাও।”
বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণা ২৬শে মার্চ দুপুরে চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগ নেতা এম এ হান্নান চট্টগ্রামের বেতারকেন্দ্র থেকে একবার এবং সন্ধ্যায় কালুরঘাট বেতারকেন্দ্র থেকে দ্বিতীয়বার প্রচার করেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতা ঘোষণা এবং এর প্রতি বাঙালি সামরিক, আধাসামরিক ও বেসামরিক বাহিনীর সমর্থন ও অংশগ্রহণের খবরে স্বাধীনতাকামী জনগণ উজ্জীবিত হয়। উল্লেখ্য, ২৭ ও ২৮ মার্চ চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ সামরিক বাহিনীর কর্মকর্তাদের গুরুত্ব বিবেচনা করে মেজর জিয়াউর রহমানকে দিয়ে উক্ত কালুরঘাট বেতারকেন্দ্র থেকে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করান ।
অপারেশন সার্চ লাইটের নির্মম পরিকল্পনা মোতাবেক নিরস্ত্র বাঙালি জনতার ওপর আক্রমণের পরপরই পাকিস্তান সেনাবাহিনী বঙ্গবন্ধুকে তাঁর ধানমণ্ডির বাসভবন থেকে গ্রেফতার করে। বঙ্গবন্ধু গ্রেফতার এড়িয়ে কেন আত্মগোপনে যাননি, তা নিয়ে নানা বক্তব্য আছে। বিভিন্ন সূত্রে প্রাপ্ত তথ্য থেকে ২৫শে মার্চের রাতে পাকিস্তানি আক্রমণের বিষয়ে নিশ্চিত হওয়ার পর বঙ্গবন্ধু তাঁর আশেপাশের সকল সহকর্মীকে তাৎক্ষণিকভাবে শহর ছাড়তে এবং তোফায়েল, রাজ্জাক ও অন্যান্য তরুণ নেতাদের বুড়িগঙ্গার অপর পাড়ে গ্রামের দিকে চলে যাবার নির্দেশ দেন। নিজে বাসায় অবস্থানের কারণ বঙ্গবন্ধু ব্যাখ্যা করেছেন দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৮ জানুয়ারি ১৯৭২ ডেভিড ফ্রস্টকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে। সাক্ষাৎকারে বঙ্গবন্ধু বলেন, সে সন্ধ্যায় আমার বাড়ি পাকিস্তান সামরিক জান্তার কমাণ্ডো বাহিনী ঘেরাও করেছিল। ওরা আমাকে হত্যা করতে চেয়েছিল । প্রথমে ওরা ভেবেছিল, আমি বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলে ওরা আমায় হত্যা করবে এবং প্রচার করে দেবে যে, ওরা যখন আমার সঙ্গে রাজনৈতিক আপোসের আলোচনা করছিল, তখন বাংলাদেশের চরমপন্থীরাই আমাকে হত্যা করেছে। আমি বাড়ি থেকে বেরুনো, না বেরুনো নিয়ে চিন্তা করলাম। আমি জানতাম, পাকিস্তানি বাহিনী এক বর্বর বাহিনী। আমি স্থির করলাম : আমি মরি, তাও ভাল, তবু আমার প্রিয় দেশবাসী রক্ষা পাক।
১৯৭১ সালের ১০ই এপ্রিল মুজিবনগরে (মেহেরপুর জেলার বৈদ্যনাথতলার আম্রকাননে) আওয়ামী লীগের নির্বাচিত গণপ্রতিনিধিরা স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের আদেশনামা জারি করেন এবং একটি সরকার গঠন করেন যা মুজিবনগর সরকার নামে পরিচিত হয়। ১৭ই এপ্রিল নির্বাচিত গণপ্রতিনিধিদের নিয়ে গঠিত বাংলাদেশের সরকার শপথ গ্রহণ করে। মুজিবনগর সরকার গঠিত হবার পর দেশের জনগণ দলে দলে মুক্তিবাহিনীতে যোগদান করে এবং মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে থাকে ।
২৫শে মার্চ মধ্যরাতে পাকিস্তানি বাহিনী অগ্নিসংযোগ ও অবিরাম গোলাবর্ষণ করে ঢাকা শহরে আক্রমণ শুরু করে। রাতের অন্ধকারে ঘুমন্ত নাগরিকদের হত্যা করা হয় । ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকবাল হল (বর্তমানে জহুরুল হক হল), সলিমুল্লাহ মুসলিম হল, জগন্নাথ হল এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বাসগৃহে হামলা করে অনেককে হত্যা করা হয় । ইয়াহিয়ার বর্বর বাহিনী বাংলাদেশে নির্বিচারে গণহত্যা, নারী নির্যাতন, অগ্নিসংযোগ, লুণ্ঠন প্রভৃতি জঘন্যতম অপরাধে লিপ্ত হয় । তাদের আক্রমণ থেকে বাঁচার জন্য লক্ষ লক্ষ নর- নারী প্রতিবেশী দেশ ভারতে আশ্রয় নেয় । কিন্তু বাঙালি ছাত্র, যুবক ও তরুণরা গোপনে সংঘবদ্ধ হয়ে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে দেশের ভিতরে থেকে গেরিলা পদ্ধতিতে এবং সম্মুখযুদ্ধে পাকবাহিনীকে পর্যুদস্ত করতে শুরু করে । দেশের মানুষ বীর মুক্তিযোদ্ধাদের খাদ্য, বস্ত্র ও আশ্রয় দিয়ে সহযোগিতা করে । ফলে পাকিস্তানবাহিনী অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে ।
মুক্তিযুদ্ধের প্রাথমিক পর্যায়ে পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ আন্দোলন চলছিল অপরিকল্পিত ও অবিন্যস্তভাবে। মুজিবনগর সরকার গঠিত হওয়ার পর থেকে মুক্তিযুদ্ধ সংগঠিতভাবে পরিচালিত হতে থাকে । তৎকালীন ইপিআরের বাঙালি সদস্য, পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বাঙালি সৈনিক ও অফিসারদের সমন্বয়ে নিয়মিত সেনা ব্যাটালিয়ন গঠন করা হয় । নিয়মিত সেনা ব্যাটালিয়ন নিয়ে পরে তিনজন সেক্টর কমান্ডারের নামের আদ্যক্ষরে কে-ফোর্স, এস-ফোর্স ও জেড-ফোর্স নামে তিনটি ব্রিগেড গঠিত হয় । সেনাসদস্য ও অন্যান্য মুক্তিযোদ্ধারা মুক্তিবাহিনী বা মুক্তিফৌজ নামে পরিচিতি লাভ করে। কখনো এরা গেরিলা নামেও পরিচয় লাভ করে। এই বাহিনীর সদস্যরা মুক্তিযুদ্ধে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন । তারা দেশের অভ্যন্তরে পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে গেরিলা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে এবং তাদের গোয়েন্দা শাখা পাকিস্তানি বাহিনীর গতিবিধি ও নানা কর্মকাণ্ডের সংবাদ মুক্তিবাহিনীকে সরবরাহ করত । গেরিলাদের মধ্যে ছাত্র ও কৃষকদের সংখ্যা ছিল সবচেয়ে বেশি ।
মুজিবনগর সরকার সমগ্র বাংলাদেশকে এগারটি সেক্টরে বিভক্ত করে এবং প্রতিটি সেক্টরের দায়িত্ব একেকজন কমাণ্ডারের হাতে ন্যস্ত করে । সেক্টর কমাণ্ডারদের অধীনে নিয়মিত বাহিনীর পাশাপাশি অনিয়মিত গেরিলা যোদ্ধারা নিয়োজিত ছিল । উল্লেখ্য, দশ নম্বর সেক্টরের কোনো আঞ্চলিক সীমানা ছিল না। এটি গঠিত হয়েছিল নৌ-কমাণ্ডারদের নিয়ে । প্রচলিত কায়দায় যুদ্ধের পাশাপাশি গেরিলাযুদ্ধের রণকৌশল গ্রহণ করে মুক্তিবাহিনী হানাদার বাহিনীকে পর্যুদস্ত করে ফেলে। ক্রমাগত যুদ্ধে জনবিচ্ছিন্ন পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ক্রমশ হীনবল ও হতাশ হয়ে পড়ে । পাকিস্তানের সামরিক শাসক প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধকে পাক-ভারত যুদ্ধ হিসেবে দেখানোর জন্য ভারতের ওপর বিমান আক্রমণ চালায়। ওরা ডিসেম্বর পাকিস্তান সরকার ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। কিন্তু তাদের সকল চেষ্টা ব্যর্থ হয়ে যায়। ৪ঠা ডিসেম্বর ভারতের লোকসভা বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। উক্ত সিদ্ধান্ত মোতাবেক ভারত সরকার ৬ই ডিসেম্বর বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দান করে । এসময়ে বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনী ও ভারতের নিয়মিত সেনাবাহিনীর সমন্বয়ে একটি যৌথ কমান্ড গঠন করা হয়। এই যৌথ কমান্ড জলে, স্থলে ও আকাশপথে প্রবল আক্রমণ চালার। ফলে মাত্র কয়েক দিনের যুদ্ধে পাকবাহিনী সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত ও পরাজিত হয় ।
মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জনের পূর্ব মুহূর্তে ১৪ই ডিসেম্বর পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর এ দেশীয় দোসররা দেশের শ্রেষ্ঠ বুদ্ধিজীবীদের অনেককে রায়ের বাজার ও মিরপুর বধ্যভূমিতে নিয়ে নৃশংসভাবে হত্যা করে। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে মানবতাবিরোধী এই বর্বর কাজে সহায়তা করেছে রাজাকার ও আলবদর বাহিনী। দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের নির্মমভাবে হত্যা করার মধ্য দিয়ে তারা এ জাতিকে মেধাশূন্য করতে চেয়েছে। ১৯৭২ সালে ঢাকার মিরপুরে শহিদ বুদ্ধিজীবীদের স্মরণে স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হয়েছে।
যৌথবাহিনীর সুপরিকল্পিত আক্রমনের মুখে পাকিস্তান হানাদার বাহিনী নৈতিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ে । অবশেষে ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর হানাদার পাকবাহিনীর অধিনায়ক জেনারেল নিয়াজী ৩,০০০ (ভিরানব্বই হাজার) পাকিস্তানি সৈন্য, বিপুল পরিমাণ রসদ ও আগ্নেয়াস্ত্রসহ রেসকোর্স ময়দানে আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মসমর্পণ করে। বিশ্বের মানচিত্রে রক্তের অক্ষরে লিখিত হয় স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের নাম ।
নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধে নারী-পুরুষ, হিন্দু-মুসলিম, শিশু-বৃদ্ধ নির্বিশেষে ৩০ লক্ষ বাঙালি প্রাণ হারায় এবং ২ লক্ষ ৭৬ হাজার মা-বোনের সম্ভ্রমহানি ঘটে। গ্রামের পর গ্রাম পুড়িয়ে ছারখার করে দেওয়া হয় । ১ কোটি মানুষ দেশ ত্যাগ করে ভারতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়। দেশের সকল শ্রেণি, পেশা ও বয়সের মানুষের সম্মিলিত প্রয়াস ও আত্মত্যাগের বিনিময়ে আমরা বিজয় অর্জন করতে সমর্থ হয়েছি ।
অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন রচিত ‘বঙ্গবন্ধু কীভাবে আমাদের স্বাধীনতা এনেছিলেন' গ্রন্থে বঙ্গবন্ধুর নিজের কথোপকথন থেকেও জানতে পারি। স্বাধীনতার পরে বঙ্গবন্ধুর আমন্ত্রণে অনেকের সাথে অন্নদাশংকর রায় ঢাকায় এসেছিলেন। বঙ্গবন্ধুর সাথে কথোপকথন সম্পর্কে তিনি লেখেন, “শেখ সাহেবকে আমরা প্রশ্ন করি, ‘বাংলাদেশের আইডিয়াটি প্রথম কবে আপনার মাথায় এলো?’ ‘শুনবেন?’ তিনি (বঙ্গবন্ধু) মুচকি হেসে বললেন, ‘১৯৪৭ সাল । আমি সুহরাবর্দী (সোহরাওয়ার্দী) সাহেবের দলে। তিনি ও শরত্বসু চান যুক্তবঙ্গ । আমি চাই সব বাঙালির এক দেশ। ... থেকে খালি হাতে ফিরে এলেন সুহরাবর্দী ও শরৎ বোস। কংগ্রেস বা মুসলিম লীগ কেউ রাজি না তাদের প্রস্তাবে। তখনকার মতো পাকিস্তান মেনে নিই। কিন্তু আমার স্বপ্ন সোনার বাংলা। হঠাৎ একদিন রব উঠল, আমরা চাই বাংলা ভাষা । আমিও ভিড়ে যাই ভাষা আন্দোলনে। ভাষা আন্দোলনকেই একটু একটু করে রূপ দিই দেশভিত্তিক আন্দোলনে । পরে এমন একদিন আসে যেদিন আমি আমার লোকদের জিজ্ঞেস করি আমাদের দেশের নাম কী হবে? কেউ বলে পাক বাংলা। কেউ বলে পূর্ব বাংলা। আমি বলি, না বাংলাদেশ। তারপর আমি স্লোগান দিই, ‘জয় বাংলা’। ... ‘জয় বাংলা' বলতে আমি বোঝাতে চেয়েছিলুম বাংলা ভাষা, বাংলাদেশ ও বাঙালি জাতির জয় যা সাম্প্রদায়িকতার উর্ধ্বে।'
মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও আদর্শে যুদ্ধ বিধ্বস্ত বাংলাদেশ পুনর্গঠন:
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নিজের শক্তির ওপর আস্থা স্থাপন করে, নিজের দেশের প্রতি শ্রদ্ধায় অবিচল থেকে, দেশের বিচ্ছিন্ন সকল শক্তিকে এক জায়গায় সংহত করে সর্বোপরি দেশের আপামর জনসাধারণকে আত্মশক্তিতে বলীয়ান করে মুক্তিযুদ্ধের জন্য উদ্বুদ্ধ করেছেন। দীর্ঘ নয় মাস সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্যদিয়ে স্বাধীনতা অর্জিত হলেও বাংলাদেশ একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে পরিণত হয় । এই যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পূর্ণগঠন নতুন সরকারের সামনে বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দেয় । নানা সীমাবদ্ধতার মধ্যেও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর (১৯৭২-৭৫) সময়কালে যে সকল সফলতা অর্জন করেন তা' যুদ্ধবিধ্বস্ত নতুন একটি রাষ্ট্রের জন্য নিঃসন্দেহে বিরাট সাফল্য। দেশের পূর্ণগঠনে বঙ্গবন্ধু সরকারের (১৯৭২-৭৫) গৃহীত পদক্ষেপ সংক্ষেপে নিম্নে তুলে ধরা হলো-
১. ভারতীয় সৈন্যদের দেশে ফেরত পাঠানো: বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারত যেহেতু সরাসরি অংশগ্রহণ করেছিল তাই ভারতীয় সৈন্য যুদ্ধ পরবর্তীতে বাংলাদেশে অবস্থান করছিল। মুক্তিযুদ্ধে চূড়ান্ত বিজয়ের পর থেকে ৩ মাসেরও কম সময়ের মধ্যে বঙ্গবন্ধু সরকার ভারতীয় মিত্র বাহিনীর সৈন্যদের দেশে ফেরত পাঠানোর ব্যবস্থা করেন ।
২. পুনর্বাসন: বঙ্গবন্ধু সরকারের অন্যতম সফলতা হচ্ছে ভারতে আশ্রয় নেয়া ১ কোটি লোককে পুনর্বাসন করা । মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহনের জন্য যারা পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে আশ্রয় নিয়েছিল তাদেরকে দেশে ফিরিয়ে এনে পূর্নবাসন করেছিলেন। এছাড়াও মুক্তিযুদ্ধে যারা শহীদ হয়েছিলেন তাদের পরিবারকে আর্থিক সাহায্যদান, নির্যাতিতা মা-বোনদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করেছিলেন। সরকার তার সফল কুটনীতি দ্বারা পাকিস্তানে আটকে পড়া ১ লক্ষ ২২ হাজার বাঙালীকে দেশে ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করেন।
৩. সংবিধান প্রণয়ন: বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সরকারের অন্যতম সফলতা হচ্ছে দ্রুততম সময়ের মধ্যে দেশের জন্য সংবিধান প্রণয়ন। দায়িত্ব গ্রহনের মাত্র ১০ মাসের মধ্যে বাংলাদেশের জন্য একটি উত্তম সংবিধান প্রণয়ন সরকারের বিশেষ কৃতিত্ব। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও আদর্শের উপর ভিত্তি করে রচিত সংবিধানের চারটি মূলনীতি হচ্ছে গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও জাতীয়তাবাদ ।
৪. জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠান: ১৯৭০ সালে পাকিস্তানে যে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় তা ছিল যুক্ত পাকিস্তানী কাঠামোতে। বাংলাদেশের সংবিধান প্রণীত হওয়ার পর পর বঙ্গবন্ধু দেশে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের উদ্যোগ করেন। ১৯৭৩ সালের ৭ই মার্চ প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ৩০০ আসনের মধ্যে ২৯৩টি আসনে জয়লাভ করেন।
৫. শিক্ষাক্ষেত্রে অগ্রগতি: বঙ্গবন্ধু সরকার অল্প সময়ের মধ্যে শিক্ষা ব্যবস্থাকে বিজ্ঞান ভিত্তিক করার জন্য ১৯৭২ সালে ড. কুদরাত-এ-খুদার নেতৃত্বে শিক্ষা কমিশন গঠন করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের কালাকানুন বাতিল করে গণতান্ত্রিক অধ্যাদেশ ৭৩ প্রণয়ন করেন। এছাড়াও বঙ্গবন্ধু সরকারের সময়কালে ৩৮ হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয়করণ এবং এসকল স্কুলে কর্মরত ১ লক্ষ ৬৫ হাজার শিক্ষকের চাকুরি সরকারিকরণ করা হয়। সম্পদের সীমাবদ্ধতা থাকা সত্ত্বেও বঙ্গবন্ধু সরকার ১১ হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয়, ৪০০ মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও ৯০০ মহাবিদ্যলয় ভবন পূনর্নির্মাণ করেন। জাতীয় জীবনের সর্বক্ষেত্রে বাংলা ভাষা ব্যবহারের নির্দেশনাও দেওয়া হয়।
৬. যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন: বঙ্গবন্ধু সরকারের উল্লেখযোগ্য সাফল্য হচ্ছে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন। বঙ্গবন্ধু সরকার হার্ডিঞ্জ ও ভৈরব ব্রীজসহ ৫৬৭টি সেতু নির্মাণ ও মেরামত, ৭টি নতুন ফেরী, ১৮৫১টি রেলওয়ে ওয়াগন ও যাত্রীবাহী বগী, ৪৬০টি বাস, ৬০৫টি নৌযান ক্রয় এবং চট্টগ্রাম চালনা বন্দর থেকে মাইন উদ্ধার করে স্বল্প সময়ের মধ্যে দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থা পুনঃস্থাপন করতে সক্ষম হয়।
৭. আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে সফলতা: বঙ্গবন্ধু সরকারের অন্যতম সফলতা হচ্ছে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে সুনাম অর্জন । বঙ্গবন্ধু অত্যন্ত দক্ষতার সাথে শুরু থেকেই বাংলাদেশের জন্য সবার সাথে বন্ধুত্ব নীতি অবলম্বন করেন ৷ তাই বাংলাদেশে ১৯৭২ সালে কমনওয়েলথের, ১৯৭৪ সালে জাতিসংঘ ও ইসলামী সম্মেলন সংস্থার সদস্য পদ লাভ করে । বাংলাদেশ ঐ সময় পাকিস্তানসহ ১৪০টি রাষ্ট্রের স্বীকৃতিও অর্জন করে।
শুরু থেকেই বাঙ্গালীরা পশ্চিম পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠীর বৈষম্যমূলক নীতি ও কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিল । আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের মূলে ছিল স্বতন্ত্র জাতিসত্তার চেতনা, যাকে আমরা বলি ‘বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদ”। স্বতন্ত্র জাতিরাষ্ট্র গঠনের জন্য আমাদের মুক্তিযুদ্ধ হঠাৎ করে শুরু হয়নি। ভাষা আন্দোলন থেকে এর যাত্রা শুরু হয়েছিল। তারপর ধাপে ধাপে আমরা বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে মুক্তিসংগ্রামের দিকে ধাবিত হয়েছি। ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক বক্তৃতার পর সারা দেশে সংগ্রামের প্রস্তুতি শুরু হয়ে যায়। পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর আত্মসমর্পন ও দেশের স্বাধীনতা লাভের পর ৮ জানুয়ারি ১৯৭২ পাকিস্তানের কারাগার থেকে বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দেয়া হয়। এর পর ১০ জানুয়ারি ১৯৭২ তিনি স্বদেশে ফিরে দেশের পূর্ণগঠন কার্যক্রম শুরু করেন। দেশের সংবিধানে বলা হয়েছে ‘প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ' (অনুচ্ছেদ ৭ (১))। ‘ধর্ম যার যার, রাষ্ট্র হবে সবার'- এ চেতনা ও আদর্শকে সামনে নিয়ে বাংলাদেশকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাবার জন্য আমাদের সকলকে একযোগে কাজ করতে হবে।
আরও দেখুন...